• Health Tips

আত্মমুগ্ধতা (Narcissism)

by osudpotro | Dec 11, 2022 05:37 am

আত্মমুগ্ধতা (Narcissism)

নিজেকে অন্যের থেকে বড় মনে করা বা আত্ম-অহংকার মূলক স্বভাবের পৃষ্টপোষকতাকে বলে Narcissism।যদিও ‘আত্মকেন্দ্রিকতা’বা ‘আত্মপ্রেম’বোঝাতে ‘‘নার্সিসিজম’ শব্দটি চালু হয়েছিল। যারা নিজেদের সৌন্দর্যে বা ক্ষমতায় বা আচরনে আসক্ত বা অতিশয় আত্নপ্রেমে যে আসক্ত তাহকে বলে নার্সিসিস্ট (Narcissist)। মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী এটি এক ধরনের অসুস্থ্যতা, যার কিছু সুস্পষ্ট লক্ষণ ব্যক্তির আচরণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তবে আচরণগত এসব বৈশিষ্ট্যের বেশ কয়েকটি আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই আছে। কিন্তু সেটা রোগলক্ষণ কিনা তা নির্ভর করে এসবের মাত্রার উপর।

জ্ঞানীরা এই ধরনের আচরণকে এক প্রকার মানসিক রোগ হিসেবে গণ্য করেছেন, এবং তাদের ভাষাই এই রোগকে Narcissistic personality disorder (NPD) বলা হয়ে থাকে।

  • নার্সিসিজম” এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য এবং ধরনসমূহ:

      সবসময় নিজের গুণাবলী প্রকাশ ও নিজেই নিজের প্রশংসা করা নার্সিসিজমের একটি বড়

 বৈশিষ্ট্য।

এছাড়াও নিচে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলও বেশীরভাগ নার্সিসিস্ট এর ভিতর লক্ষ্য করা যায়ঃ

  • স্বার্থপরতা
  • মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার আকাঙ্ক্ষা
  • যেকোনো মূল্যে জেতার চরম আকাঙ্ক্ষা
  • সামাজিক ক্ষমতার উপস্থাপন
  • মনস্তাত্ত্বিকভাবে অপমানজনক আচরণ করা
  • অন্যের অনুভূতির প্রতি অসহানুভূতিশীল হওয়া

নিচে ৬ ধরনের নার্সিসিস্ট এর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হল

নার্সিসিজমের ধরন

বৈশিষ্ট্য

বোঝার উপায়

প্রকাশ্য

স্বার্থপরতা এবং অন্য লোকেদের প্রতি অবজ্ঞা 

অত্যধিক পরিমান নিজের প্রশংসা নিজেই করা

সকলের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হতে চাওয়া

সাম্প্রদায়িক

নিজেকে মহান কোন ব্যক্তি ভাবা

শুধুমাত্র নিজের প্রশংসা পাওয়ার জন্য সামাজিক কাজ করা

নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে সবার কাছে দাবী করা

পরস্পরবিরোধী

যেকোনো মূল্যে নিজেকে জেতানোর চেষ্টা করা

অনেক প্রতিযোগিতামুলক মনোভাব নিয়ে চলা

লড়াইমূলক কর্মকাণ্ড করা

তুচ্ছ বিষয়েও জিততে চাওয়া

আত্মকেন্দ্রিক

সামাজিক ক্ষমতা লালসা

নিজের বুদ্ধিমত্তাকে অতিরঞ্জিত করা

নিজের গুরুত্ব সম্পর্কে অন্যদের বোঝানো

সামাজিক বা পেশাদার কাজে নিজেকে সবার শ্রেষ্ঠ মনে করা

গুপ্ত / গোপন

গভীর নিরাপত্তাহীনতা ভোগা এবং ব্যর্থতার ভয় করা 

সমালোচনা গ্রহণ করতে না পারা

অন্যের ব্যর্থতা কামনা করা

দুর্বলের উপর নিজের ক্ষমতা দেখানো

বিদ্বেষপরায়ণ

যেকোনো বিষয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠা

শারীরিক বা মানসিকভাবে অন্যদের অপমান করা

সহানুভূতির অভাব

আশেপাশের মানুষদের বিভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করা

 

  • প্রকাশ্য: এই ধরণের নার্সিসিস্টদের চিহ্নিত করা সম্পর্কে বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ফ্রেইটাগ বলেছেন -

“এদের চিহ্নিত করা খুব সহজ কারণ তারা অধিকাংশ সময় নিজেদের প্রশংসা নিয়ে ব্যস্ত থাকে”

 

এদের ভিতর আরও যে বিষয়গুলো লক্ষ্য করা যায় তা হলঃ

  • অন্যদের মনোযোগ পেতে চাওয়া
  • নিজেকে অন্যদের থেকে সৎ / ভাল দাবী করা
  • প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব প্রকাশ করা

সাইকোথেরাপিস্ট লরেল স্টেইনবার্গ বলেছেন “প্রকাশ্য নার্সিসিস্টরা তাদের কৃতিত্বগুলি ভাগ করে নেওয়াকে কখনই মেনে নিতে পারে না” । 

 

  •  

 

  • পরস্পরবিরোধী: এই ধরণের নার্সিসিস্টরা অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে থাকে এবং জয়ী হওয়া বা সেরা হওয়ার দিকে বেশী মনোনিবেশ করে।

      থমাসের মতে "তাদের মধ্যে 'তাদের বনাম আমার' মনোভাব রয়েছে যা তাদের যুক্তিতে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য অতিরিক্ত কথা বলতে বাধ্য করে” ।

স্টেইনবার্গ বলেছেন “তাদের কাছে কোন বিষয় নিয়ে তর্ক করার উপযুক্ত কারণ নাও থাকতে পারে কিন্তু তারা কেবল তর্কের খাতিরে তর্ক করে এবং নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রচার করে” ।

 

২০২০ সালের সমীক্ষা অনুসারে আরও কিছু লক্ষণ উঠে আসে, যেমনঃ-

  • অহংকারী 
  • অত্যাচারী
  • অবমূল্যায়ন

স্টেইনবার্গ বলেছেন “কাউকে শোষণ করার অর্থ হতে পারে কারও কাছ থেকে সুবিধা নেওয়া বা নিজের সুবিধার জন্য তাদের প্রতারণা করা, এবং কারও অবমূল্যায়ন করা মানে কাউকে নীচে নামিয়ে দেওয়া সেটি হতে পারে, সরাসরি বা গোপনে” ।

  • আত্মকেন্দ্রিক: এই ধরণের নার্সিসিজম হল সামাজিক ক্ষমতা চাওয়া বা প্রকাশ করা।

স্টেইনবার্গ বলেছেনঃ-

"এই ধরণের নার্সিসিস্ট নাটকীয়ভাবে তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাকে অতিরিক্ত নাটকীয় করে তোলে এবং তারপরে যখন তাদের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়, তখন তারা সমালোচনার প্রতি অসহিষ্ণু হয়,"

আত্মকেন্দ্রিক নার্সিসিস্ট সনাক্ত করার জন্য আরও কিছু লক্ষণ নিচে দেওয়া হলঃ

  • তারা তাদের বুদ্ধিমত্তা এবং সৃজনশীলতাকে সবসময় অতিরঞ্জিত করবে
  • নিজের সুবিধা অনুযায়ী কাজ করবে
  • নিজেকে সামাজিক ক্ষমতার অধিকারী মনে করবে
  • অন্যদের থেকে নিজেকে বেশি সক্ষম দাবী করবে

গুপ্ত / গোপন: গোপন নার্সিসিস্টরা বেশি অন্তর্মুখী হতে থাকে এবং এমনকি লাজুক স্বভাবের ও হতে পারে।

স্টেইনবার্গ বলেছেনঃ- 

"এই ধরনের নার্সিসিস্ট কোনোভাবেই ব্যর্থ হওয়ার ধারণার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না, এবং ফলস্বরূপ, সমালোচনা গ্রহণে ক্ষমতা তাদের নেই বললেই চলে। তারা প্রতিনিয়ত কোনো কিছুতে ব্যর্থ হওয়ার ভয়ের সাথে লড়াই করে” ।

থমাস বলেছেন গুপ্ত / গোপন নার্সিসিজমের অন্য কিছু লক্ষণ আছে, যেমনঃ

  • সমালোচনার প্রতি খুবই সংবেদনশীল এবং একে ব্যক্তিগত আক্রমণ হিসেবে দেখে
  • তারা নিজের কর্মের দায়ভার কখনই গ্রহণ করে না
  • এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আক্রমনাত্মক হয়ে থাকে
  • সবার সাথে সরাসরি প্রতিযোগীতা করতে পছন্দ করে
  • অন্যদের সমালোচনা করে বা ইচ্ছাকৃতভাবে খারাপ পরামর্শ দিয়ে তাদের নিচে নামাতে পছন্দ করে।

 

  • বিদ্বেষপরায়ণ: ফ্রেইটাগ বলেছেন – “বিদ্বেষপরায়ণ নার্সিসিজম সবচেয়ে বিপজ্জনক।এদের মধ্যে সাইকোপ্যাথিক বৈশিষ্ট্য থাকে এবং আন্তঃব্যক্তিগতভাবে দুঃখজনক বা আক্রমণাত্মক হওয়ার প্রবণতা থাকে এবং তারা এতটাই আত্মনিমগ্ন হতে পারে যে তারা অন্যদের অনুভূতির প্রতি পুরোপুরি চিন্তা করে না। "

থমাসের মতে বিদ্বেষপরায়ণ নার্সিসিজমের কিছু লক্ষণ আছে, যেমনঃ-

  • মিথ্যা বলা
  • অন্যকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা
  • অত্যন্ত আক্রমণাত্মক হওয়া
  • অন্যকে অপমান করে আনন্দ পওয়া
  • অন্যদের প্রতি কম সহানুভূতিশীল হওয়া

 

  • প্রতিকার

     এখন প্রশ্ন হলো এই রোগের কবল থেকে বাঁচার উপায় কী? এ ব্যাপারে প্রথমেই বলতে হয় যে, এটি নিজে নিজে সারানো বেশ মুশকিল। প্রথমত, এটা অনেকগুলো আচরণগত বৈশিষ্ট্যের সমম্বয়ে সৃষ্ট এক ধরণের জটিল সমস্যা, যা হুট করে বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে দূর করা সম্ভব নয়, যেখানে ধূমপানের মতো অভ্যাসকে ত্যাগ করাটাই অসম্ভব মনে হয় ধূমপায়ীর কাছে। দ্বিতীয়ত, আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ সম্পর্কিত সচেতনতার মানে এই নয় যে তিনি বুঝে গেছেন করণীয় কী, কারণ রোগের ধরণ অনুযায়ী প্রতিকারের উপায় সচেতনতা দিয়ে জানা সম্ভব নয়—এজন্য দরকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পেশাদারী অভিজ্ঞতা। সেজন্য  একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট/থেরাপিস্ট-এর বিকল্প খুঁজতে যাওয়া নিতান্তই অনর্থক। তবে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিকে, দুঃখকে বুঝবার এবং মনোযোগি শ্রোতা হওয়ার চেষ্টা করা, নিয়মিত আত্ম-সমালোচনা করা, বই পড়া, নতুন বন্ধু তৈরি করা এবং সামাজিক কাজকর্মে খোলা মন দিয়ে অন্যদের সাথে অংশগ্রহণ করা, ইত্যাদি এই রোগের নিরাময়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে থাকে। আসুন আমারা নার্সিসিজ্‌ম থেকে নিজেরা দূরে থাকি, অন্যদেরকেও দুরে রাখি।