ডায়াবেটিস শব্দটি আমাদের দেশের সবার কাছেই বেশ পরিচিত। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারের কোন না কোন সদস্য এই রোগে আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ডায়াবেটিস এখন একটি মহামারি রোগ। এই রোগের অত্যধিক বিস্তারের কারণেই সম্প্রতি এমন ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
প্রশ্ন আসতেই পারে, ডায়াবেটিস কী? আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ডায়াবেটিস এমনই একটি রোগ, যা কখনো সারে না। কিন্তু এই রোগকে সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
ডায়াবেটিস এক ধরনের মেটাবলিক ডিজঅর্ডার। এক্ষেত্রে শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদন ও তা ব্যবহার করতে পারে না। অনেকের ক্ষেত্রে ইনসুলিন একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়। যে কোনো খাবার খাওয়া পর আমাদের শরীর সেই খাদ্যের শর্করাকে ভেঙে চিনিতে রুপান্তরিত করে। অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নামের যে হরমোন নিসৃত হয়, তা শরীরের কোষগুলোকে নির্দেশ দেয় চিনিকে গ্রহণ করার জন্যে। এই চিনি কাজ করে শরীরের জ্বালানি বা শক্তি হিসেবে। শরীরে যখন ইনসুলিন তৈরি হতে না পারে অথবা এটা ঠিক মতো কাজ না করে তখনই ডায়াবেটিস হয়। এর ফলে রক্তের মধ্যে চিনি জমা হতে শুরু করে।
ডায়াবেটিস দুই প্রকার। যথা-
- টাইপ-১ ডায়াবেটিস
- টাইপ-২ ডায়াবেটিস
- টাইপ-১ ডায়াবেটিস- সাধারণত এটি তরুণদের হয়, আর এটি খুব দ্রুত দেখা দেয়। তবে টাইপ-১ ডায়াবেটিসের কারণ এখনো জানা যায় নি। চিকিৎসকদের মতে টাইপ-১ ডায়াবেটিস টাইপ-২ এর চেয়ে অনেক কম দেখা যায়। টাইপ-১ ডায়াবেটিস হচ্ছে ছোটবেলা থেকে যাদের ইনসুলিনের মাত্রা খুবই কম থাকে অথবা একদমই থাকে না তারাই সাধারণত টাইপ-১ ডায়াবেটিস এর রোগী। শিশুকাল থেকে একজন মানুষের শরীরে ইনসুলিন কম থাকলে তাদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস এর রোগী বলা হয়। এরকম ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কৃত্রিমভাবে ইনসুলিন সরবরাহ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এই ডায়াবেটিসে ইনসুলিন ছাড়া এর কোন ওষুধ নেই।
- টাইপ-২ ডায়াবেটিস- টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রধাণত ৩৫-৪০ বছরের পরে দেখা দেয়। অগ্ন্যাশয় থেকে শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী ইনসুলিন তৈরি করতে না পারলে কিংবা উৎপন্ন কম হলে তখন টাইপ-২ ডায়াবেটিস বলা হয়। এ ধরনের ডায়াবেটিস এর ক্ষেত্রে ইনসুলিন ব্যবহার না করে বিশেষ পর্যবেক্ষণের সাহায্যে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব বলে জানা যায়। বর্তমানে ৯০% টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগী রয়েছে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস বংশগত হতে পারে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস ইনসুলিন গ্রহন না করে ব্যায়াম ও ওষুধ গ্রহণ করে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
অনেক কারণে ডায়াবেটিস হতে পারে। জিনগত কারণে হয়। এটা প্রথম কারণ। ওজন বা স্থূলতার সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক রয়েছে।
- ডায়াবেটিসের বিভিন্ন লক্ষন-
- ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
- তেষ্টা পাওয়া
- নিয়মিত খাওয়ার পরও ঘন ঘন খিদে
- প্রচণ্ড পরিশ্রান্ত অনুভব করা
- চোখে ঝাপসা দেখা
- শরীরের বিভিন্ন অংশের কাটাছেঁড়া সহজে সারে না
- খাওয়া সত্ত্বেও ওজন কমে যাওয়া
- হাতে-পায়ে ব্যথা বা মাঝে মাঝে অবশ হয়ে যাওয়া
দৈনিক খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের পাশাপাশি আমাদের কিছু কাজ বর্জন করতে হবে। তাহলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের জন্য আরও সহজ হবে। যেমনঃ
- দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকুন
- দ্রুত ঘুমানো চেষ্টা করুন
- কম তেলযুক্ত খাবার খান
- মিষ্টি যুক্ত খাবার পরিহার করুন
- ফাইবার জাতীয় খাবার গ্রহন করুন
- অ্যালকোহল যুক্ত খাবার পরিহার করুন
- শর্করা জাতীয় খাবার খান
- ফাস্টফুড পরিহার করুন
- ফ্যাট জাতীয় খাবার পরিহার করুন
- প্রতিদিন অন্তত ১ ঘণ্টা হাঁটার অভ্যাস করুন
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায়
শুধুমাত্র চিকিৎসার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। একজন ডায়াবেটিস রোগীর জন্য চিকিৎসা যতটা জরুরী ঠিক তেমনি নিয়ম অনুযায়ী চলাফেরা এবং খাদ্য গ্রহণ করাও জরুরি।
- রাত ৮-৯ টার ভিতরে ঘুমিয়ে পড়তে হবে।
- রাতে খাওয়ার পূর্বে আপেল সিডার অল্প পরিমাণে খেতে হবে এবং এক গ্লাস পানির সাথে আদা ও লেবুর রসের সাথে খেলে সেটি আরও উপকারী।
- শর্করা জাতীয় খাবারের পরিবর্তে শাকসবজি প্রচুর খেতে হবে।
- অল্প অল্প করে খেতে হবে, কখনো পেট ভরে খাওয়া যাবে না।
- স্বাস্থ্যসম্মত তেল যেমন খাঁটি সরিষার তেল খেতে হবে। এ সব ধরনের তেল শরীরের খাদ্যের চাহিদা কমিয়ে দেয়, যার ফলে ক্ষুধা কম লাগে আর অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের প্রয়োজন হয় না। শরীরে অতিরিক্ত চর্বি বাড়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
- নিয়মিত প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হবে। কমপক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়াম বা হাটাহাটি করতে হয়। ব্যায়াম করার ফলে শরীরে ইনসুলি তৈরি হতে সাহায্য করে।
- সামুদ্রিক মাছ খুব উপকারী। রূপচাঁদা,স্যালমন, ইলিশ সহ অন্যান্য মাছ খেতে হবে। এছাড়াও পাঙ্গাস, পুটি, মলা মাছ এর মতো ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ মাছ এগুলো খেতে হবে।
- সবুজ জাতীয় শাকসবজি খেতে হবে, কারণ এ গুলোতে ক্যালোরি কম থাকে। শর্করার পরিমাণ কম থাকে এবং প্রচুর ভিটামিন ও মিনারোল থাকে যা আমাদের দেহের জন্য অধিক উপকারী ও প্রয়োজন।
- রসুন অধিক কার্যকর। প্রতিদিন ২-৩ টা রসুনের কোয়া কাঁচায় খেলে শরীরে রক্তে কোলস্টেরলের মাত্রা কমে রাখে। যার উপকারের ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।
- প্রতি মাসে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমপক্ষে একবার পরীক্ষা করা দরকার। দুই তিন মাস পরপর HbA1c পরীক্ষা করতে হবে। ৫-৬ মাস পর পর অথবা বছরে অন্তত ১ বার কিডনি, লিপিডি পরীক্ষা করতে হবে। নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করতে হবে কারণ ডায়াবেটিস রোগীর চোখে সমস্যা হয় এবং চোখে ঝাঁপসা দেখে।
- একজন ডায়াবেটিস রোগীর খাবাার তালিকা:
সকাল: সকাল সাতটা থেকে আটার মধ্যে সকালের নাস্তা শেষ করতে হবে। সকালের নাস্তাটা দেরিতে হলেও যেন ৯.০০টার পর না যায় তা খেয়াল রাখতে হবে।
নাস্তায় আপনি রুটি/চিড়া/খই/ মুড়ি/ওটস্/ যেটা আপনার পছন্দ সেটাই নিতে পারেন। সাথে নিরামিষ আর একটা ডিম।
১০.০০ থেকে ১১.০০ টার মধ্যে আপনি নিতে পারেন আপনার পছন্দমতো কোনো একটা ফল। মিষ্টি ফল হলে ১/২ কাপ পরিমাণে খাবেন।
দুপুরের খাবার: দুপুর বেলায় আপনি আপনার খাবারে পরিমানমত ভাত, মাছ/মুরগীর মাংস, শাকসবজি, সালাদ ও লেবু ইত্যাদি রাখবেন। দুপুরের খাবার হবে ১.০০ থেকে ২.০০ টার মধ্যে।
বিকালের নাস্তা: বিকালের নাস্তায় আপনি রাখতে পারেন সুপ, ছোলা, চিনি ছাড়া বিস্কুট, মিষ্টি ছাড়া পিঠা, বাদাম, মুড়ি, রং চা ইত্যাদি।
রাতের খাবার: রাতে আপনি আপনার পছন্দমতো এবং পরিমানমতো রুটি বা ভাত বা ওটস নিতে পারেন। সাথে দুপুরের মতো মাছ/মুরগী, সবজি, সালাদ, লেবু ইত্যাদি রাখতে হবে। তবে রাতের খাবারটা আপনাকে রাত আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে শেষ করে ফেলতে হবে।
ডায়াবেটিস-আক্রান্ত মানুষের হতাশা, আতঙ্ক আর কষ্টের মতো আবেগী মুহূর্তগুলোতে সবার আগে পাশে দাঁড়াতে পারে পরিবার। পরিবার অনেকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ না–ও হতে পারে, কিন্তু এটাই একজন মানুষের সত্যিকারের পৃথিবী। প্রতিটি পরিবার হোক ডায়াবেটিসের প্রকোপমুক্ত।