by osudpotro | Nov 20, 2022 10:09 am
ডেঙ্গু কি?
ডেঙ্গু হল এক প্রকার ভাইরাস । ডেঙ্গু ভাইরাস হলো ফ্ল্যাভিভাইরিডি পরিবার ও ফ্ল্যাভিভাইরাস গণের অন্তর্ভুক্ত মশা বাহিত এক সূত্রক আরএনএ (RNA) ভাইরাস। এটি ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী। এখনও পর্যন্ত এই ভাইরাসের পাঁচটি সেরোটাইপ পাওয়া গিয়েছে। যাদের প্রত্যেকেই পূর্ণরূপে রোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম। এডিস ইজিপ্টি মশা এই ভাইরাসের বাহক। একই মশা ইয়েলো ফিভার ভাইরাস, জিকা ভাইরাস, চিকুনগুনিয়া ভাইরাসেরও বাহক।
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর আবির্ভাব
বাংলাদেশে ২০০০ সালে সর্বপ্রথম ডেঙ্গু জ্বর দেখা দেয়। দাবি করা হয়েছিল সেই বছরে ৯৩ জন মারা গেছে। ৩ বছর পরে মৃত্যুর সংখ্যা ধীরে ধীরে প্রায় শূন্যে নেমে আসে। তবে এটি আবার ২০১৮ সালে ফিরে আসে, এতে ২৬ জন মারা যায় এবং ১০,১৪৮ জন আক্রান্ত হয়।
ডেঙ্গু জ্বর কি?
ডেঙ্গু জ্বর একটি এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস জনিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সচরাচর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। সাধারণভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০২ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেবার পর আবারো জ্বর আসতে পারে। এর সাথে শরীরে ব্যথা মাথাব্যথা, চেখের পেছনে ব্যথা এবং চামড়ায় লালচে দাগ (র্যাশ) হতে পারে। তবে এগুলো না থাকলেও ডেঙ্গু হতে পারে।
ডেঙ্গু প্রধানত দুই ধরনের হয়ে।
ডেঙ্গু জ্বর কেন হয়?
ভাইরাসবাহিত এডিস ইজিপ্টাই নামক মশার কামড়ে দেখা দেয় ভাইরাস জ্বর, যার নাম ডেঙ্গু জ্বর। জীবাণুবাহী এডিস মশা কামড়ানোর ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে একজন মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে ভাইরাসবিহীন কোনো এডিস মশা কামড়িয়ে অন্য ব্যক্তিকে কামড়ালে সেও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের বিভিন্ন লক্ষন সমূহ
ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা
অনেকের ধারণা ডেঙ্গু ছোঁয়াচে রোগ। কেউ কেউ মনে করেন, ডেঙ্গু জ্বরের রোগীকে স্পর্শ করলেই রোগটি স্পর্শকারীর মাঝে ছড়িয়ে যাবে। আবার কারো ধারণা, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে পৃথক রাখা উচিত। ডেঙ্গু ছোঁয়াচে রোগ নয়। কাজেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে স্পর্শ করলেই, একই বিছানায় ঘুমালে, একই তোয়ালে ব্যবহার করলে কিংবা একই কাপড় ব্যবহার করলে, একই গ্লাস কিংবা প্লেট ব্যবহার করলে অন্যদেরও একই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই।
এই ধারণাটি পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি সেরোটাইপ রয়েছে। এই ৪টির মধ্যে যে কোনো ১টি থেকেই ডেঙ্গু জ্বর হতে পারে। কাজেই ডেঙ্গু ভাইরাসের যে কোনো একটি সেরোটাইপে একবার আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার পর ভবিষ্যতে ভাইরাসের সেই সেরোটাইপটি দ্বারা আর আক্রান্ত হওয়ার কথা নয়। কারণ শুধু সেই সেরোটাইপটিতে রোগীর আজীবন প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। কিন্তু ডেঙ্গু ভাইরাসের বাকি ৩টি সেরোটাইপ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ঠিকই রয়ে যায়। তবে কেউ যদি পৃথক পৃথকভাবে ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি সেরোটাইপ দ্বারা জীবনে ৪ বার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে বাকি জীবনে আর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কথা নয়।
ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণু বাতাসে ছড়ায় না। শুধু ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত এডিস মশার কামড়ে যে কোনো ব্যক্তি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারে। এডিস মশা ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণু বহন করে। কাজেই বাতাসে ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণু উড়ে বেড়ানোর সুযোগ নেই।
অনেকে এখনও মনে করেন, ডেঙ্গু জ্বর মাত্রই মৃত্যু ঝুঁকি এবং এতে প্রায়ই রোগী মারা যায়। এই ধারণা একেবারেই ভুল। সঠিকভাবে চিকিৎসা করা হলে সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত প্রায় শতভাগ রোগীই ভালো হয়ে যান। যদিও বলা হয় ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে মৃত্যুহার ৫ থেকে ১০ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবে, এই হার ১ শতাংশের নিচে।
জ্বর কমে গেলে বা ভালো হয়ে গেলে অনেকে মনে করেন রোগ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু জ্বরে মারাত্মক সমস্যা হবার সময় আসলে এটাই। এসময় প্লাটিলেট কাউন্ট কমে যায় এবং রক্তক্ষরণসহ নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। জ্বর কমে যাবার পরবর্তী কিছুদিন হলো ক্রিটিকাল পিরিয়ড। এসময় সবার সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরী। বরং জ্বর চলে যাওয়ার পরের সময়টাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ডেঙ্গু জ্বর ভাইরাস বাহিত, মশার কামড়ের মাধ্যমে হয়ে থাকে। মায়ের বুকের দুধে এই ভাইরাস থাকে না। কাজেই, আক্রান্ত অবস্থায় মা বাচ্চাকে তার বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন। এ নিয়ে বিভ্রান্তির অবকাশ নেই।
ডেঙ্গু জ্বরে প্লাটিলেট কমে যাওয়ায় নয়, বরং রোগী মারা যায় ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে। তাই প্লাটিলেটের সংখ্যা ১০ হাজারের ওপরে থাকলে ও রক্তপাত না থাকলে, এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। ৮৯ থেকে ৯০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট কমে বটে, তবে এদের মধ্যে মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশের জটিল পর্যায়ের নিচে যায়। ৫ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর মারাত্মক রক্তক্ষরণ জটিলতা হয় আর রক্ত পরিসঞ্চালন দরকার হতে পারে। প্লাটিলেটের সংখ্যা ২০ হাজারের নিচে নামলে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা থাকে। প্লাটিলেট যদি ৫ হাজারের কম হয়, তখন মস্তিষ্ক, কিডনি, হৃৎপিণ্ডের মধ্য রক্তক্ষরণের ভয় থাকে।
জেনে রাখা ভাল একজন সুস্থ মানুষের দেহে প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকার স্বাভাবিক সংখ্যা প্রতি ঘন মিলিলিটারে দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ।
ডেঙ্গু জ্বর হলে কি করা উচিত?
যদিও ডেঙ্গু প্রতিরোধ করার মত কোন ওষুধ এখনও আবিষ্কার হয়নি কিন্তু সতর্ক থাকলে ও কিছু নিয়ম মেনে চললে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব।
কমলা, ডালিম, ডাবের পানি, পেঁপে পাতার জুস, হলুদ, মেথি, ব্রুকলি, পালংশাক, কিউইফল, লেবুর শরবত, খাবার স্যালাইন ইত্যাদি।
তৈলাক্ত ও ভাজা খাবার, মসলাযুক্ত খাবার, ক্যাফিনযুক্ত পানীয়
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে করণীয়-
মূলত এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। তাই মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্য এডিস মশার বংশবিস্তারের উপযোগী বিভিন্ন আধারে, যেমন, কাপ, টব, টায়ার, ডাবের খোলস, গর্ত, ছাদ ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে।
বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মতামতঃ
চলতি বছর দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ ও মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে প্রথমবারের মতো শনাক্ত হওয়া মশাবাহিত এই রোগের চতুর্থ স্ট্রেন (ধরন) মৃত্যুর সংখ্যা বাড়াতে বড়ো ভূমিকা রাখছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
ডেঙ্গু ভাইরাসের এই নতুন ধরন চিহ্নিত হবার পর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভাইরাসে একজন ব্যক্তি জীবদ্দশায় চারবার আক্রান্ত হতে পারেন, যার কোনো কোনোটি চরম আকার ধারণ করতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এক দিনে সর্বোচ্চ ৩১০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ইতিকথাঃ
ইংরেজিতে একটা কথা আছে "prevention is better than cure" ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে আমাদের করণীয় হলো এডিস মশার বংশ-বিস্তার রোধ করা। ডেঙ্গু মশা এবং তার বংশবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ- দুটোই আমাদের চারপাশে বিদ্যমান।